বাহারের এক নিত্য উপহার—টি শার্টে বিপ্লব এনে বদলে দিল আজিজ মার্কেট!

ছবি- নিত্যউপহার ডটশপ
Spread the love

নিত্য উপহার বাংলাদেশে টি-শার্ট শিল্পকে একেবারে দেশীয় ঘরানায় মোড় দিয়েছে। একটি পশ্চিমা পোশাকের ওপরও কীভাবে দেশি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলা যায়, তা দেখিয়ে দিয়েছে ফ্যাশন হাউজ ‘নিত্য উপহার’। সহজ জনপ্রিয়তার রাস্তায় না হেঁটে তারা আমাদের নিজস্ব নকশা ও গৌরবের বিষয়গুলোই তুলে ধরার চেষ্টা করেছে…

এপ্রিল, ২০০৪। স্লোভাকিয়া থেকে বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছেন তরুণ পরিব্রাজক টম বরিস। ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন ঢাকার পথঘাট, মানুষজন, বাড়িঘর। একদিন নীল‌ক্ষেতে পুরোনো বইয়ের দোকানে গিয়ে এক তরুণের গায়ে থাকা টি-শার্টের প্রতি তার দৃষ্টি আটকাল। ‘এ রকম টি-শার্ট কোথায় পাব?’

সেই তরুণের নাম ছিল শরীফ। টমকে শরীফ উত্তরে বললেন, ‘আমি ওদিকেই যাব—চাইলে আমার সাথে তুমিও আসতে পারো’।

হাতে ভ্রমণসহায়ক নির্দেশিকা, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে সেই স্লোভাকিয়ান যুবক টম এলেন নিত্য উপহারের শো-রুমে। শো-রুমে ঝোলানো পোশাকের মাঝে তিনি যেন খুঁজে পেলেন এক টুকরো বাংলাদেশকে।

হাতে ভ্রমণসহায়ক নির্দেশিকা, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে সেই স্লোভাকিয়ান যুবক টম এলেন নিত্য উপহারের শো-রুমে। শো-রুমে ঝোলানো পোশাকের মাঝে তিনি যেন খুঁজে পেলেন এক টুকরো বাংলাদেশকে।

ছোট্ট দোকানটির চারপাশে ঝোলানো নানা রঙবেরঙের টি-শার্ট। কোনোটার বুকে ফিদেল কাস্ত্রো, কোনোটায় আবার বব মার্লি, কোনোটায় লেখা ‘জীবানন্দ দাশের সুরঞ্জনা’, কোথাও আছে দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কান্তজিউ মন্দির, কোনোটায় আবার এস এম সুলতানের ছবি। আছে লোকজ নকশা।

টম সবগুলো টি-শার্ট ধরে ধরে দেখলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের পতাকার প্রতিফলন আছে, এমন টি-শার্ট নেই?’ 

কিন্তু শেষপর্যন্ত দুটি টি-শার্ট নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। আর পতাকার টি-শার্ট ডাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

জুন কি জুলাইয়ে টমের মেইল এল– ‘টেলিভিশনে দেখছি, তোমার দেশে বন্যা হয়েছে, তুমি ঠিক আছ তো? টি–শার্ট পেয়েছি। খুবই ভালো হয়েছে। একদিন দেখবে, তোমার এই টি-শার্ট অনেক জনপ্রিয় হবে। এবার বেশি টি-শার্ট নিতে পারিনি, আবার যখন বাংলাদেশে আসব, তোমার অনেক টি-শার্ট নেব’।

সে বছরের শেষে প্রথম আলোর ‘নকশা’র বিজয় দিবস সংখ্যার শেষপাতায় একটি লেখা ও ছবি ছাপা হয়েছিল। লাল–সবুজ টি-শার্ট পরে মডেল কান্তা, নিশো আর ধীয়ান গিরির গায়ে একটা বড়দের টি-শার্ট, হাতে একটা ক্রিকেট ব্যাট। নকশার ওই সংখ্যায় লাল–সবুজ পোশাকে সেই একটাই ছবি ছিল যত দূর মনে পড়ে। সে বছর অন্যান্য জাতীয় দৈনিকের ফিচার পাতাগুলোয় এ নিয়ে বেশ ছবি ও লেখা ছাপা হয়েছিল।

ছবি- নিত্যউপহার ডটশপ

‘সময়ের বিবর্তনে স্মারকের ধারণাও বদলেছে। পরিব্রাজক ইবনে বতুতা হয়তো স্মারক হিসেবে মসলিনই নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রিয় টম, আপনাকে একটা টি-শার্টই দেওয়া গেল। আপনার কথাই সত্যি হয়েছে, এই টি-শার্ট শুধু জনপ্রিয়ই হয়নি, আমাদেরও নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে’।

কথাগুলো লিখে রেখেছেন নিত্য উপহারের স্বত্বাধিকারী বাহার রহমান। প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব ওয়েবসাইট ব্লগে গেলেই পাওয়া যাবে নিত্য উপহারের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সব গল্প।

ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয়, বরং একটি ক্যানভাস

শখের কোনোকিছু আমরা যেমন নিজ হাতে যত্নের সাথে গুছিয়ে রাখি, নিত্য উপহারকে ঘিরেও এই সব গল্পের কথা একটু একটু করে গুছিয়ে রাখছেন বাহার রহমান। হয়তো নিত্য উপহার তার কাছে কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয়। বরং একটি ক্যানভাস। আর এই ক্যানভাসের মানসশিল্পী বাহার রহমান।    

শিল্পী বাহার রহমান সেই তরুণ বয়স থেকেই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। ছাত্রজীবনে লেখাপড়ায় যে খুব মনোযোগী ছিলেন- তা নয়। কিন্তু বই পড়তে ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন কবিতা পড়তেও।  বিএ পরীক্ষার পর বিভিন্ন টুকটাক লেখালেখি বা প্রকাশনার কাজ দিয়ে তার একটু-আধটু উপার্জন শুরু হয়। লিখতে যেমন ভালোবাসতেন, তেমনি আড্ডাও দিতেন লেখক-কবিদের সঙ্গে। পিজি হাসপাতালের পেছনে আমতলার সামনে গিয়ে আড্ডায় যোগ দেওয়া ছিল নিত্যদিনের রুটিন।

ছবি- নিত্যউপহার ডটশপ
কিন্তু, পাশাপাশি রুটি রোজগারের চিন্তাও ছিল। অবশ্য ততোদিনে আজিজের তিনতলার সামনের দিকে ‘নিত্য উপহার’ দোকানে স্ক্রিনপ্রিন্টের কিছু কাজ তিনি শুরু করে দিয়েছেন।    
 
সেখানে স্ক্রিনপ্রিন্টের মাধ্যমে হাতে তৈরি কাগজ দিয়ে বিয়ের কার্ড তৈরি করা এবং মাঝে মাঝে সেসব নব-দম্পতির বিবাহ-বার্ষিকীতে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য ডাক ঠিকানার তালিকা নবায়ন, সংশোধন ও কার্ড পাঠানো- এই করে চলছিল নিত্য উপহারের দিনগুলো।  
 
একবার এই শুভেচ্ছা কার্ড পাঠাতে গিয়ে এক কাণ্ডও ঘটেছিল। বিয়ের প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে মেয়ের বাড়ির ঠিকানা বরাবর কার্ড পাঠান। দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকীতে যখন আবার পাঠালেন, মেয়েটির বাবা জানালেন, সেবার ঐ মেয়েটির বিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছিল। তাই দয়া করে এভাবে বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা পাঠিয়ে লজ্জায় ফেলবেন না!  
 
অনেকে আবার ‘নিত্য উপহার’- এ ছোট্ট এই উপহারটুকুর জন্যই বার বার আসতেন। এভাবেই বিয়ে, জন্মদিন বিভিন্ন দিনের জন্য কার্ড শুভেচ্ছা পাঠানোর সঙ্গে মিশে আছে অনেক গল্প। আর এসবের অলংকরণ, গ্রাফিক ডিজাইন করে দিতেন সব্যসাচী হাজরা। 
 
বিকেল ও সন্ধ্যায় প্রায় নিয়মিত সব্যসাচী হাজরা, তনুজা ভট্টাচার্য ও অনুপম চক্রবর্তী, মাঝেমধ্যে আরও তরুণতর সব্যসাচী মিস্ত্রি, রাজিব, ওয়াসিফ, নিজার, মাসুম, নিলিম, তানভির, টুটুল, ফাইজা, গোরা, উজ্জ্বল, শিবু, সুমনসহ আরও অনেকে আসতেন এখানে।  
নিত্য উপহারের প্রতিষ্ঠাতা বাহার রহমান। ছবি- নিত্যউপহার ডটশপ

সময়টা যে আরও নতুন কিছু সূচনার, কে জানত!

এই স্ক্রিনপ্রিন্টের কাজ করতে করতে মাথায় এলো ফ্যাশন চিন্তা। স্ক্রিনপ্রিন্টকে পোশাকে নিয়ে এলে কেমন হয়?  কিন্তু আজিজ সুপার মার্কেট তখন বই, ক্যাসেট, সাহিত্য- সংগীতের এক আড্ডাখানা। আজিজে এই চিন্তার, চর্চার, আড্ডার এই ধারা গড়ে উঠেছিল আসলে বইয়ের দোকানগুলোকে কেন্দ্র করে। মার্কেটের নিচতলার প্রায় পুরোটাই ছিল বইয়ের দোকান। ছিল বই, সাহিত্যসংশ্লিষ্ট নানা আয়োজন। 

আজকের নবীনদের কাছে  এই মার্কেট প্রধানত পোশাকের, বিশেষত টি-শার্টের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু, এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনটা এনে দিলো যে প্রতিষ্ঠান এবং যার হাত ধরে তিনি হলেন, নিত্য উপহারের স্বত্বাধিকারী বাহার রহমান। তিনি নিজেও ছিলেন আজিজের আড্ডারই একজন মানুষ। 

আবার সত্তরের দশক থেকেই বাংলাদেশে টি-শার্টের চাহিদা বাড়তে থাকে। হালকা কাপড়ের আরামদায়ক বস্ত্র টি-শার্ট বা গোল গলার গেঞ্জি। যেখানে সুযোগ থাকে নকশা ও বার্তায় পরিধানকারীর রুচি, ফ্যাশনবোধ কিংবা সাংস্কৃতিক পরিচয় ফুটিয়ে তোলার।

কিন্তু, টি-শার্টের এই সাংস্কৃতিক পরিচয় শুরু থেকে ছিল না এদেশে। কারণ একটা  সময় পর্যন্ত  টি-শার্ট মানেই  ছিল সেকেন্ড হ্যান্ড মার্কেট আর গার্মেন্টসের বাতিল টি-শার্টের ছড়াছড়ি। সুলভমূল্যে পাওয়া যেত বলে সেই টি-শার্টের চাহিদাও ছিল অনেক। 

তাই বাহার ভেবে দেখলেন, টি-শার্টের জনপ্রিয়তা এবং স্ক্রিনপ্রিন্টের ধারণা এ দুটোকে যদি এক করা যায়, তবে তা এক নতুন ধারার সূচনা করবে। কারণ আজিজ হলো তরুণদের আড্ডাস্থল। আর এই তরুণদের সাথে যদি এই নতুন ধারার টি-শার্টের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়, তবে দেশের ইতিহাসে শুরু হবে এক নতুন ধারার যাত্রা। 

এর পর ছয়–সাত বছরে বাজার জরিপ হয়ে গেল। যোগ হলো স্ক্রিনপ্রিন্টে মুদ্রণদক্ষতা আর টি-শার্টে সবচেয়ে দরকারি শিল্পী ও শিল্পভাষা শেখা। বাকি থাকল ক্যানভাস, অর্থাৎ টি-শার্ট। আর্থিক সহযোগিতা করলেন দুই বন্ধু আলমগীর হোসেন আর মো. আজিজুর রহমান। তারা কয়জন মিলে ঠিক করলেন, এই সিরিজের নাম দেওয়া হবে, ‘সিরিজ অব হেরিটেজ অ্যান্ড অ্যাপোসল’ আর ট্যাগলাইন থাকবে,  “উই আর ওল্ডার দ্যান দ্য রকস অ্যামং হুইচ উই সিট”— এ–ই ছিল তাদের সৃজন দল। এভাবেই শুরু হলো তাদের স্বপ্নযাত্রার প্রস্তুতিপর্ব।  

যেহেতু আজিজে ছিল সেসব শিল্পবোধ ও সংস্কৃতিমনা মানুষজনের আনাগোনা, তাই এই নতুন ধারার পোশাকের ক্রেতাও হয়ে উঠলেন তারাই। ধীরে ধীরে তাদের ব্যবসায়িক সাফল্য অন্যদেরও টেনে আনল এই ব্যবসায়। পরে যারা ব্যবসায় এসেছেন তারাও একইরকম চিন্তা বা বৈশিষ্ট্য নিয়েই শুরু করেছিলেন। তাই এ কথা নিঃসন্দেহেই বলা যায় যে, নিত্য উপহারই আজিজ সুপার মার্কেটের পুরো রূপ পালটে দিয়েছে।   

তবে বাহার রহমান মনে করেন, এখানেই তাদের সঙ্গে অন্যদের একটি পার্থক্য। 

যে চেতনা বা দেশপ্রেম থেকে নিত্য উপহার এই নতুন পথে হাঁটা শুরু করে, অন্যরা সেই দেশপ্রেম নয়, বরং ব্যবসায়িক সাফল্যটুকু দেখেই অনুপ্রাণিত হয়েছিল। ফলে তাদের স্থায়িত্ব বা ব্যবসা খুব লাভজনক হয়েছে সেটা বলা যায় না। বরং বাইরের অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড আজিজে এসে দোকান নিয়েছে শুধু বিক্রির জায়গা হিসেবে। যারা চেনেন, জানেন এত কিছুর ভিড়েও নিত্য উপহার তাদের কাছে প্রথম পছন্দ।  

বাম থেকে বাহার রহমান, চন্দ্রশেখর সাহা, সব্যসাচী হাজরা এবং ধ্রুব এষ। ছবিসূত্র- নিত্যউপহার ডটশপ

শিল্পসংস্কৃতি-নির্ভর নকশার টি-শার্ট নিয়ে আসে এক নতুন যুগের 
 
আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলার ১৬ নম্বর দোকানে নিত্য উপহারের যাত্রা শুরু ১৯৯৪ সালে। টি-শার্ট নিয়ে নিত্য উপহার কাজ শুরু করে ২০০১ সাল থেকে। ৬টি নকশার টি-শার্ট নিয়ে তাদের কার্যক্রম শুরু হয়।

এরপর থেকে টি–শার্ট কখনো শিল্পীর ক্যানভাস, কখনো হয়ে ওঠে স্মারক, স্যুভেনির বা মোমেনটাম—আবার কখনো গর্বের ও প্রেরণার প্রতীক। নিত্য উপহারের পর শিল্প-সংস্কৃতিনির্ভর নকশার টি-শার্ট নিয়ে ভাবনা দেশের ফ্যাশন বাজারে প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়। ২০০১ সালের পর থেকে দেশি নকশার টি-শার্ট মানেই আজিজ সুপার মার্কেটের টি-শার্ট। শুধু টি-শার্ট নয়, শাড়ি, পাঞ্জাবী, সালোয়ার কামিজ, ফতুয়া, ওড়না চাদর সবকিছুর জন্যই আজিজ সুপার মার্কেট দেশি ঘরানার ফ্যাশন বাজার হিসেবে পরিচিতি পাওয়া শুরু করে। সে ধারাবাহিকতা রয়েছে এখনও।

২০০১ সালের পয়লা বৈশাখে ধ্রুব এষ, সব্যসাচী হাজরার আঁকা নিয়ে, অনুপম চক্রবর্তী, তনুজা ভট্টাচার্য, মুনেম ওয়াসিফ, আমিরুল রাজিব, টুটুল ও একঝাঁক তরুণের নানাবিধ কাজের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল পোশাকে ‘ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ব্যক্তিত্ব’ ধারাবাহিকের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চারুকলা অনুষদের সামনে টি-শার্টের সড়ক প্রদর্শনী উদ্বোধন করেছিলেন শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য। 

এভাবেই শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, আবুল বারক্ আলভি, চন্দ্রশেখর সাহা, শেখ আফজাল, ধ্রুব এষ, আনিসুজ্জামান সোহেল, কনক আদিত্য ও সব্যসাচী হাজরার মতো দেশবরেণ্য অগ্রজ শিল্পীদের সঙ্গে তরুণ শিল্পীদের মেলবন্ধন ও পথচলা শুরু। টি-শার্টে, শাড়িচাদরে নিজের শহর, দেশ ও ইতিহাস ঐতিহ্য উপস্থাপন করার এ এক চলমান প্রচেষ্টা। 

এরপর ২০০২ সাল থেকে টি-শার্টে বাংলা বর্ণমালাকে ফুটিয়ে তোলা নিয়ে কাজ করতে শুরু করে  ফ্যাশন হাউস নিত্য উপহার। পোশাকে বর্ণমালার ব্যবহারও তাদের থেকেই শুরু বলা যায়। 

তাদের ডিজাইনকৃত ‘বাংলাদেশ’ টি-শার্টটি বেশ জনপ্রিয়। বিদেশি যেকোনো পর্যটক বাংলাদেশে এলে স্যুভেনিয়র-এর তালিকায় প্রথমেই থাকে এই টি-শার্ট, জানান বাহার রহমান।

ছবি: টিবিএস

শুধু ফ্যাশন নয়, জাতীয় অর্জনের মুহুর্তগুলোর সঙ্গী  নিত্য উপহার  

‘রূপসী বাংলা’ শিরোনামে একটি আলোকচিত্র প্রতিযোগিতারও আয়োজন করে নিত্য উপহার। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য তরুণ-তরুণী তাদের তোলা আলোকচিত্র পাঠিয়েছেন। সেখান থেকে সেরা ১৫টি আলোকচিত্র দিয়েই বানানো হয়েছে টি-শার্টগুলো। 

২০০৫ -এ ছোটদের জন্য ‘বসে আঁকো’ ছবি আঁকা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিশুশিল্পীদের আঁকা নিত্য উপহারের টি-শার্টের ক্যানভাস উজ্জ্বল হয়েছে। ‘বসে আঁকো’ প্রতিযোগিতার আয়োজন ২০১২ পর্যন্ত নিয়মিত ভাবেই হতো।  পরবর্তী সময়ে নানা কারণে এ আয়োজন আর হয়ে উঠেনি।

২০০৬ থেকে চাদর ও শাড়ি ডিজাইন করা শুরু করে নিত্য উপহার।  শীতে, বিভিন্ন জাতীয় দিবস ও বছরের বিভন্ন সময়ে নিত্য উপহার চাদর শাড়িও নিয়ে আসতো। এখন চাদর আর নেই সেভাবে। অনিয়মিত হলেও শাড়ি এখনো করে চলেছে ব্রান্ডটি। 

পোশাকের অন্যান্য মাধ্যম- যেমন পাঞ্জাবী, টপস, সেলোয়ার- কামিজ নিয়ে কাজ করার অভিপ্রায়ে ‘এক্সপ্লোর ফ্যাশন টেলেন্ট ২০০৭‘ আয়োজনের মধ্য দিয়ে একদল তরুণ ফ্যাশন ডিজাইনার খুঁজে বের করার চেষ্টা করে নিত্য উপহার। বিশিষ্ট ফ্যাশন ডিজাইনার ও গবেষক চন্দ্রশেখর সাহার পরিকল্পনা ও সার্বিক অনুষ্ঠান ডিজাইনে এই আয়োজনের ২০ তরুণকে নিয়ে মাসব্যাপী ওয়ার্কশপে দেশের প্রথিতযশ ফ্যাশন ডিজাইনার, ফটোগ্রাফার, সাংবাদিক ও রুপচর্চা বিশেষজ্ঞরা আসেন।

এছাড়া একটি ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থাও তারা করেছিলেন। এরকম বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে নিত্য উপহার দেশীয় ফ্যাশন বিষয়ে নানা বাস্তব শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা লাভ করে। শেষপর্যন্ত অবশ্য পাঞ্জাবী, সেলোয়ার-কামিজ বা টপস নিয়ে নিত্য উপহারের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে টি-শার্টের পাশাপাশি শাড়ি, চাদরের ওপর কাজ করে যাচ্ছে নিত্য উপহার।  

২০০৬ সাল থেকে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নেয়া বাংলাদেশ গণিত দলের নিয়মিত সাথী হয়েছে নিত্য উপহার। ২০১৮ সালে বিশ্বমঞ্চে দেশের জন্য প্রথম স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড দলের গায়ে ছিল নিত্য উপহারের টি-শার্ট। এছাড়াও, আন্তর্জাতিক জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াড, আন্তর্জাতিক ফিজিক্স অলিম্পিয়াড, জ্যামিতি অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ দলের সাথে নিয়মিত সঙ্গী হয় নিত্য উপহারের টি-শার্ট।  

পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ জয় যেমন- তেমনি দুর্গম পাহাড়-পর্বত, সাগর, ঝর্ণায় অ্যাডভেঞ্চারে নিয়মিত ভাবে নিত্য উপহারের টি-শার্ট সঙ্গী হয়েছে সেসব তরুণদের।  এভারেস্ট জয়ী সজল খালেদ সামিট শেষে আর ফিরে আসেননি- সজল খালেদের সাথে সেখানে ঘুমিয়ে আছে লাল-সবুজের স্মারক টি-শার্ট জড়িয়ে নিত্য উপহারও।  

মানুষদের কাজের দিনপঞ্জিও হতে পারে এই নিত্যউপহারডটশপ 

শুধু কেনাকাটার সাইট নয়। একে একটি ছোটোখাটো লাইব্রেরি বা আর্কাইভ বলা যেতে পারে। ছোট ও বড়দের জন্য ১।৩৮০টিরও অধিক টি-শার্ট, শতাধিক ডিজাইনের চাদর, শাড়ি এবং অন্যান্য পোশাকগুলো সময়ের ধারাবাহিকতায় সব ইতোমধ্যে  গুছিয়ে রাখা হয়েছে ওয়েবসাইট এবং আর্কাইভে।   

এছাড়া, মডেল ও অনেক গুণী আলোকচিত্রির বিভিন্ন সময়ে তোলা ছবি পাওয়া যাবে এই সাইটে, পাওয়া যাবে জড়িত সব মডেলদের ছবিও। এদের অনেকই দেশে ও পৃথিবীর বৃহৎ প্রেক্ষাপটে অসামান্য সব কাজ করে চলেছেন- আজ নিজ নিজ প্রেক্ষাপটে তাদের অনেকেই আদর্শ মডেলও বটে।

অর্থাৎ নিত্য উপহারের সঙ্গে যুক্ত সৃষ্টিশীল সব শ্রদ্ধেয় মানুষদের কাজের দিনপঞ্জিও হতে পারে এই নিত্যউপহার ডটশপ। 

নিত্য উপহার কখনো হারিয়ে না যায়……

নিত্য উপহার বাংলাদেশে টি-শার্ট শিল্পকে একেবারে দেশীয় ঘরানায় মোড় দিয়েছে। একটি পশ্চিমা পোশাকের ওপরও কীভাবে দেশি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলা যায়, তা দেখিয়ে দিয়েছে ফ্যাশন হাউজ ‘নিত্য উপহার’। সহজ জনপ্রিয়তার রাস্তায় না হেঁটে তারা আমাদের নিজস্ব নকশা ও গৌরবের বিষয়গুলোই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ফলে গার্মেন্টস পোশাকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশীয় ঐতিহ্য বহনকারী এসব পোশাকের টিকে থাকা অনেকটাই হুমকির মুখে বলে মনে করেন বাহার রহমান।

আবার ইদানীং কালে বিভিন্ন মিম বা কৌতুকপূর্ণ নকশার টি-শার্টের কারণেও অনেকসময় ক্রেতা হারাতে হয়। অনেক সময়ই তারা দেশীয় ইতিহাস-ঐতিহ্যের চেয়ে ট্রেন্ডি- কোনো কৌতুকপূর্ণ বিষয়ের প্রতি আগ্রহী থাকে। কিন্তু নিত্য উপহার কখনোই ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে  হাল ফ্যাশনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে না। সেই সুচনালগ্ন থেকেই তারা দেশীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সাহিত্যকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতেই কাজ করে আসছে।  তাদের একটাই উদ্দেশ্য, নিজস্বতাকে ধরে রাখা। ফলে তরুণদের কাছে নিত্য উপহারের টি-শার্ট মানে অনুপ্রেরণাও। 

কিন্তু, এই অনুপ্রেরণার উৎস যেন বাহার নিজেই আজ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কোনো ব্যবসায়িক ক্ষতি বা পতন নয়। ব্যক্তিজীবনে দুই সন্তানের মৃত্যুই তাকে আজ এক ভেদহীন করে দিয়েছে।    

তার হাত ধরে তো শুধু একটি গোটা মার্কেটের রূপ বদল নয়, একটি কালেরই অবসান ঘটেছে, বলা যায়। কিন্তু, আজ যেন সেই মানুষটা নিজেই পাল্টে গেছেন। এই ২১ বছর ধরে যে প্রতিষ্ঠানটিকে নিজের সন্তানের মতো গড়েপিঠে মানুষ করেছেন, আজ যেন তার মায়া ছাড়তে চাইছেন। সবকিছু নিজ হাতে যা করে গেছেন সবটুকু ধীরে ধীরে আর্কাইভে গুছিয়ে রাখছেন। যেন বাহার হারিয়ে গেলেও, নিত্য উপহার কখনো হারিয়ে না যায়……।

রাফিয়া মাহমুদ প্রাত

[ বাহারের এক নিত্য উপহার—টি শার্টে বিপ্লব এনে বদলে দিল আজিজ মার্কেট! লেখাটি The Business Standard অনলাইন পত্রিকার ফিচারে ১৩ অক্টোবর ২০২২ তারিখে প্রকাশিত হয়েছিলো। মূল পত্রিকায় এই লিংক থেকে পড়া যাবে।]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *