আর্কাইভ বলতে ও ভাবতে পছন্দ করতাম, আদতে দেখলে একে গুদামঘর বললেই ঠিক হবে। তাকের উপর সারি দিয়ে সব নমুনা টি-শার্ট, শাড়ি ও চাদর রাখা। কয়েকটা নেপথলিন ফাঁকে ফাঁকে ছড়ানো। পলিথিনে মোড়ানো প্রতিটি প্যাকেটে একটা করে সিলিকনপ্যাক দেওয়া হয়েছে- যাতে কাপড়গুলো মোটামুটি জীবন পায়। প্রতিটি পলিপ্যাকে দুইটা করে নিম পাতাও রাখার কথা হয়েছে- একটু সময় ও সুযোগ হলেই রাখা যাবে। কমই আসা হয়, বাতাস চলাচল কম; তাই এ ঘরে গুমোট গন্ধ। এডজাস্ট ফ্যান লাগানো হয়েছে- গন্ধটা কমবে এমন ভাবনায়। মাঝে মাঝে দরজা-জানলা খুলে বসার চেষ্টা করে যাচ্ছি- গুমোট গন্ধটাও কিঞ্চিত কমেছে। চারপাশের দেয়ালজুড়ে এমনকি মাঝখানেও দুই সারি তাক, ধুলোয় জর্জরিত তাকে কিছু বইপত্র, রয়েছে নানান পদের দরকারি বে-দরকারি নমুনা পোশাক, কাপড়, কাগজ ও নথিপত্রের স্তূপ, এখানেই রয়েছে আমার, নিত্য উপহারের অতীত দিনের দিনপঞ্জি, এরই পরতে পরতে জমেছে কত যে ব্যস্ত সমস্ত দিনের কলকোলাহল, কত যে ছবি আর গল্প- স্মৃতিমঞ্জুরীর গন্ধ। এ ঘরেই রয়েছে সেসব দিনে নিত্য উপহারের যৎসামান্য সাফল্য আর তিন’শ দুইটা ভুলের রেখাচিত্রও। সেই সুদূরের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো চোখের সামনে ভেসে বেড়াতে লাগলো।
অতিমারিকালের অলস উৎকণ্ঠাময় সময়ে এইসবের সামনে বসে স্মৃতিকাতর হয়ে অতীতের নানা কথা ভাবছিলাম।
ø
ঢাকার আকাশে নিবৃত কোণটায় সবচেয়ে অনুজ্জ্বল তারাগুলোর একটি, একরকম খালি চোখে দেখাই যায়না! গলার স্বর ফোটে কি ফোটেনা। স্কুলে লাস্ট বেঞ্চার, বন্ধুদের মাঝে সবচেয়ে ম্রিয়মাণ চুপচাপ শ্রোতা। সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছিলো। গ্রীন রোডে ক’দিন বেশ আড্ডা চলেছে- আরেকটা নতুন দৈনিক পত্রিকা বের হবে, অনেক বন্ধুরই কাজ জুটে গিয়েছে। এপ্লাই করেছিলাম; কিন্তু হলোনা। অন্য দরজা খোলা ছিলো হয়তো; কিন্তু জানতামই না কোন দরজায় কড়া নাড়তে হবে! কি করি এখন! কি করা যায়!
এমনই একদিন পিজির আমতলা থেকে বের হচ্ছি রাত ন’টার দিকে। হেঁটেই ফিরতে হবে এমনটাই নির্ধারিত, গল্প করতে করতে ফেরা যাবে। দু’একজন সঙ্গীও আছেন, তাঁরাও মোহাম্মদপুরই থাকেন, আমারই মতো কাব্যানুরাগী অথবা কবিযশপিয়াসী- তাই কাব্যদেবীর চরণে ধর্ণা দেন মাঝে-সাঝে। কবিদের কবিতার আড্ডায় যোগ না দিলেতো আর চলে না! ঠিক তখনই অবাক করা এক কাণ্ড ঘটলো। পথ আটকে দাঁড়ালেন অপি- ‘স্লামালাইকুম ভাই, কেমন আছেন!’
বললাম, ‘ভালো।’
অপি- ‘আমিতো ইয়োলো পেজে চাকরি পাইছি।’
বললাম, ‘খুব ভালো, খুব ভালো।’
অপি- ‘এই এক মাস হইলো।’
বললাম, ‘খুবই ভালো খবর।’
অপি- ‘বেতন পাইলাম আজকে।’
বললাম, ‘ভালো।’
অবাক করে হাত বাড়িয়ে বললো, ‘এই নেন আপনার টাকা।’ চারটা পাঁচ’শ টাকার নোট। তাজ্জব ব্যাপার! এমন যে হতে পারে তা কল্পনারও অতীত! উত্তেজনায় রীতিমত কাঁপন ধরে আর কি! একসাথে দু’হাজার টাকা! তাও নিজের টাকা!
হঠাৎ একটা বন্ধ জানলা খুলে গেল! আশা একরকম ছেড়ে দিয়েছিলাম, ভুলেও গিয়েছিলাম বিষয়টা। খোঁজ নিয়েছিলাম একবার, তাও বেশ আগে। বুঝেছিলাম এ টাকা পাওয়া কঠিন। তা ছাড়া বেচারা দিবে কোত্থেকে! বন্ধুদের কাছে ক্যাসেট বিক্রি করে টাকা পাওয়া সহজ নয়। সবচেয়ে বড় কথা, অপিও কয়েকটা কবিতা আবৃত্তি করেছে! তবে তো বন্ধুদের একটা আবদার থাকেই!
হ্যাঁ, জানলাটা খুলে গেল। তখন কবিতা, সেই কবিতাময় উত্তাল দিন! তখন লিটলম্যাগ, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, জহুরা মার্কেটে আমিন হোটেল, হাশেম ভাইয়ের কোহিনূর আর সিলভানায় লাগাতার আড্ডা। আর বাইরে পথঘাটে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও টিএসসিতে কবিতা-গান-নাটক-ট্র্যাজেডি, মিছিল-মিটিং, ছুটোছুটি, ককটেল, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, ব্যারিকেড, ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া নিত্য দিনের স্বাভাবিক ঘটনা। কথায় আছে- নেই কাজতো খই ভাজ! অনেকটা এমনই দশা। খই, পপকর্ন মজার খাবার, সুস্বাদু, ভালোই লাগে, তা খই-ই ভাজা যাক। নানা পরিকল্পনা মাথায় আসতো, নানা কিছুর মুসাবিদা- যেটা নেই, কখনো হয়নি, এমন অনেক কিছু করার বাতিক জাগতো। এমন বাতিকেই ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ নামে একটা আবৃত্তির ক্যাসেট বের করেছিলাম উনিশ’শ অষ্টাশিতে। সে সময়কার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সেরা আটজন তরুণ আবৃত্তিশিল্পীর আবৃত্তি নিয়ে একটা আবৃত্তি সংকলন। ক’দিন বিকেলে ধানমন্ডি চার নম্বর রোডে হাসান আরিফের বাসায়, খুব আলাপ-আলোচনা। ডালিয়া আহমেদ, আনিসুজ্জামান, হাসান আরিফ, সাগর লোহানী, সুমনা শারমিন সুমি আর সাইদ হাসান তুহিন- এঁদের সবার সাথেতো এ বিষয়ে কথা হলো; কিন্তু ইস্তেকবাল হোসেনকে পাওয়া যাচ্ছে না। শেষে এক সকালে কবি বন্ধু শিমুল মোহাম্মদকে নিয়ে জয়দেবপুরে গিয়ে শুনি, কবি, আবৃত্তিকার, ডাকসুর সাহিত্য সম্পাদক সাহেব ক্রিকেটও ভালোবাসেন, তিনি ক্রিকেট খেলতে গেছেন। সেদিন দুপুরে ইস্তেকবালের বাড়িতে ওর মায়ের হাতে মোরগ ভাত খেয়ে তারপর দেখা হলো। বিকেলে, আসন্ন সন্ধ্যার আগে ওর বাড়ির পাশের শ্মশানে বসে হাজার বছরের পুরনো স্বাদ দিলেন কুড়োলে কেটে আর চললো গল্প-গুজব। সব শেষে পাওয়া গেল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক আবৃত্তি সংগঠন স্বননের প্রতিনিধি ফারহানুর রহমান অপিকেও।
তিরিশের, সমসাময়িক কালের সেরা কবিদের কবিতা ছিলো ষাট মিনিটের এই আবৃত্তি সংকলনে- ছিলো সমবয়সি কবি বন্ধুদের কবিতাও। শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য কভার এঁকে দিয়েছিলেন। সে সময় জাতীয় কবিতা উৎসবের পোস্টার ছাপার কাজ চলছিলো, শিল্পী ইউসুফ হাসান সেই পোস্টারের ছাঁটে কভারটা ছেপে দিয়েছিলেন, খরচ দিতে হয়নি। পরে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’, ইতিহাসখ্যাত স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শহীদ নূর হোসেনের ছবিও প্রেরণা হয়েছিলো ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ ক্যাসেটের কভারে। স্বননের আরিফুল হক কুমার বললেন, ‘অপিকে পঞ্চাশটা ক্যাসেট দেন, ও বিক্রি করে দিবে।’ সেটাও বেশ ক’বছর আগের কথা।
জগতে সব প্রাপ্তি রুটিন ধরে সময় মতো ঘটেনা। যেন নিজস্ব নিয়ম আছে প্রকৃতির- এই নিয়মের বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। এই যে গাছপালা, দূরের সবুজ প্রান্তর, অরণ্য; বনস্পতি, বনদেবী আর বনবিহারি- সব বৃক্ষতো সমান ছায়া দেয়না! ফলও বিভিন্ন রকম! দেখি, জগতে লক্ষ্য স্থির করে সব কাজ করা চলেনা। সব কাজওতো সবসময় দৃশ্যমান ও হৃদয়গ্রাহ্য নয়। প্রকৃতি নিজের মতো করেই আমাদের কর্মফল ফিরিয়ে দেন, চাই বা না চাই।
ø
এমন সময় আচমকা অর্থপ্রাপ্তি। তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় এক প্যাকেট বেনসন কিনে প্রথম শলাকায় উল্টো অগ্নিসংযোগ। পরদিনই মাটিতে পা ঠেকলো যেন। আরে, টাকাতো খরচ করা যাবে না! মাথার ভেতর পুরনো বাতিকটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো, একটু পর পরই কোঁ কোঁ করে উঠছে! আরে, এতো নাছোড়বান্দা দেখছি! নিদারুণ সঙ্গীন অবস্থা- ‘এটাই সুযোগ- সদ্ব্যবহার করো, এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও’ কে যেন অনবরত বলে চলেছে কানে কানে। আর মহান ইচক দুয়েন্দেও যেন অনবরত গেয়ে চলেছেন, ‘নিত্য তোমার যে ফুল ফোটে, ফুল বনে’।
শুরু হলো সেই বিখ্যাত সোয়া দুই বাই সাড়ে তিন ইঞ্চি সাইজের বইয়ের ভাবনা। এমন কিছু করতে হবে, যাতে থাকবে কালজয়ী সব প্রিয় কবিতার মায়াজাল আর শিল্পকর্মও। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যাঁদের আগ্রহ আছে তাঁরা যেন অবশ্যই এটা পছন্দ করেন, সেটা আরও নিশ্চিত করতে এতে ব্যবহারিক দিকও কিছু রাখা যাক! প্রথম সংস্করণের নাম রেখেছিলাম ‘মাঝে মাঝে দেখা পাই, মাঝে মাঝে পাইনা’। পরবর্তী সংস্করণের নাম ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’। কথায় আছে, ‘বৃক্ষ তোমার নাম কি- ফলে পরিচয়!’ বিষয়ের দিক থেকে সাজানোর চেষ্টা ছিলো অনেকটা, একের ভিতর পাঁচ- হরলাল চক্রবর্তীর ধাঁচে। ক্ষুদ্রতম কবিতা সংকলন- চর্যাপদ থেকে শুরু করে কালিদাসের ‘মেঘদূত’, ‘গীতগোবিন্দ’, মধ্যযুগ থেকে বিগত শতক এবং সমসাময়িক কালের কবিতার রত্নভাণ্ডারের অতুলনীয় সব পংক্তিমালা দিয়ে সাজানো হয়েছিলো ছোট পরিসর।মহাসাগরসম বাংলা কবিতার ভাণ্ডার থেকে সেরা রত্নগুলোর কিছুটা খুঁজে পেতে সহায়তা করেছিলেন দুই বন্ধু কবি সাজ্জাদ শরীফ আর সৈয়দ তারিক।
কাঁটাবন ছাপাখানা পাড়ায় প্রায়ই দেখা হতো শিল্পী খাজা জিয়ার সঙ্গে। নিকট অতীতে ও সমসাময়িক কালে যত চিত্র প্রদর্শনী হয়েছে ঢাকায়, তাঁর সংগ্রহে এর সব ক্যাটালগই ছিলো। এর মধ্যে যেমন ছিলো বনস্পতি শিল্পী ‘দোপেঁয়াজা’ খ্যাত কাজী আবুল কাশেমের প্রদর্শনীর ক্যাটালগ; তেমনি শিল্পকলা একাডেমিতে আরেক দিকপাল গুরু এস এম সুলতানের প্রথম প্রদর্শনীর ক্যাটালগও। দুই মলাটের ছোট্ট পরিসরে পালযুগ, মোগল আমল থেকে বর্তমান সময়তক শিল্পীদের নির্বাচিত চিত্রমালার প্রামাণ্য চিত্রসংগ্রহও যোগ হলো। কবিতা ও শিল্পকলার সংগ্রহটা বেশ আকর্ষণীয় ও প্রতিনিধিত্ব মূলক করার চেষ্টা হয়েছিলো। যাঁরা কবিতা ও চিত্রকলার অনুরক্ত নন, তাঁরাও যেন এটা সংগ্রহ করতে অনুপ্রাণিত হন তার ব্যবস্থাও রাখা হলো, দরকারি টেলিফোন নম্বর লেখার জায়গা এবং সাথে থাকবে প্রয়োজনীয় সব টেলিফোন নম্বরও।
আগে দর্শনধারী তারপর গুণ বিচারি। কভার রেক্সিনে বাঁধাই আর নাম সোনালী ফয়েল প্রিন্ট করা হোক! কভারের দুই কোণে ডাইরির মতো সোনালী কোণা দেওয়া যাক, মাঝেখানে চিকন সুতোর পেইজমার্কার, সম্ভব হলে টি-গিল্টও হবে সোনালী রংয়ে। সব মিলিয়ে কাজ ও খরচের মুসাবিদা হয়ে গেল আকাশ ছোঁয়া। সে এক ঝকমারি ব্যাপার, দেখাই যাকনা কি হয়!
ø
সোনারগাঁ রোডে, কাঠালবাগান ঢালের উপর ঠিক দুটো বাড়ির পরই দোতলায় তখন ‘শিল্পতরু’র অফিস। কবি আবিদ আজাদের প্রকাশনা সংস্থা ‘শিল্পতরু’। নিয়মিত কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা লেগেই থাকতো। এই প্রকাশনায় কাজ করতেন ‘প্রেসের কবিতা’ খ্যাত কবি বন্ধু আহমেদ মুজিব। সেই সুবাদে মাঝে মাঝে আসতাম। কালার ডটস থেকে ফটোকম্পোজে সব লেখা কম্পোজ করে পজেটিভও করে আনা হলো। পেস্টিং শিল্পতরুতেই করা গেল মুজিবের তত্ত্বাবধানে। আহমেদ মুজিব নিয়ে গেলেন কলাবাগান, বশিরউদ্দিন রোডে মসজিদ লাগোয়া নিশাত প্রিন্টার্সে, এখানেই শিল্পতরুর বই ছাপা হয়। চার রংয়ে ভালো কাজ করার জন্য আছে সোলনা মেশিন, আছে শর্ট ডাবল ডিমাই এবং সাথেই বাঁধাই করার ব্যবস্থাও। পরিচয় হলো মহিউদ্দিন ভাইয়ের সাথে, এটা তাঁরই ছাপাখানা। দার্শনিক সুলভ, মজার মানুষও। দেখা হলেই ট্রিপল ফাইভ এগিয়ে দিতেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে ছাপাখানার ব্যবসায় কেন তাও বললেন, সাথেই লাগোয়া তাঁর বাসস্থান। মহিউদ্দিন ভাই যত্ন করে ছেপে দিয়েছিলেন। পরে তার সাথে বিশেষ খাতির হয়ে গিয়েছিলো, ছাপার কাজগুলো নিয়ে আসতাম। একটু-আধটু বাকিও দিতেন। সেই মহিউদ্দিন ভাই একদিন হঠাৎ বললেন, ‘আপনারে নিয়া একজন একটা কথা বলছে। কে বলছে, নাম বলবোনা। কি বলছে শুনবেন!’
ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘বলেন।’
বললেন, ‘ভালো কিছু বলে নাই, এইটা ঠিক। আচ্ছা থাক, ওইটা আর না-ই বলি। বরং ওই ভদ্রলোকরে আমি কি বলছি সেইটাই আপনারে বলি, কি বলেন!’
আরো ভয়ের ব্যাপার, তবু বললাম, ‘আচ্ছা, বলেন।’
পাহাড় সমান এক ঢেউ এগিয়ে আসছে ছোট ডিঙিটার দিকে, যে কোন সময় উল্টে যাবে- হয়ে যাবে সব লণ্ডভণ্ড। আমাকে অবাক করে দিয়ে মহিউদ্দিন ভাই বললেন, ‘বললাম, বাহারকে হয়তো আগেও দেখছেন, আজকেও দেখতেছেন, আবার পাঁচ বছর পরও হয়ত দেখবেন। তারপর যদি আপনার কিছু বলার থাকে, তখন আমাকে বলবেন। এর মধ্যে বাহাররে নিয়া আমারে কিছু আর বলবেন না প্লিজ।’
কোনো কিছু শুনতে পাই না আর, স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম চুপচাপ কিছুক্ষণ। অবাক কাণ্ড, এই ঢেউয়ে কোনো অঘটন ঘটলোনা, ডিঙিটা নিটোল শান্ত জলধারায় এসে আবার ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চললো। একটু পর মহিউদ্দিন ভাই আবার বললেন, ‘আমি ম্যানেজার সাহেবরে বলছি, ক্লাসিক আর বাহার, এই দুইটা হিসাব আমার, বাকি সব হিসাব আপনি দেখবেন’। কোথায় চার’শ পাঁচ’শ রিম ছাপার কাজ আর কোথায় এক দেড় রিম কিনতেই পান্তা ফুরায় অবস্থা!
পৃথিবীতে কত বিস্ময়ের বিষয়ই না পথে পথে ছড়িয়ে রয়েছে। নীরবে কত মহাজন আমাদের পথের পাথেয় হয়ে থাকেন। হীনজনের হীনকর্মই সব শেষ নয়। জানিনা, পরবর্তী সময়ে মহিউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে আমার অজানা শুভাকাঙ্ক্ষীর এ বিষয়ে কখনো আর কথা হয়েছিলো কিনা! তবে নাতিদীর্ঘ চলার পথে অনেক বড় মানুষেরই দেখা পেয়েছিলাম। কখনো জেনে আনন্দ পেয়েছি, আবার কখনো বুঝতেও পারিনি। নিত্য দিনের যাবতীয় কর্ম আর যাবতীয় খোলসের আড়ালে সেদিন একজন বড় মানুষের দেখা পেয়েছিলাম, তাঁর কাছে রয়ে গেছে বেশ ঋণ। যে ঋণ শোধ হওয়ার মতো নয়, ওটাই হলো পুঁজি। এর বহুদিন পর জেনেছিলাম, সেই যে কলাবাগানের বশিরউদ্দিন রোড, যার নাম অনুসারে এই রাস্তার নামকরণ, তিনি আসলে মহিউদ্দিন ভাইয়ের বাবা। মহিউদ্দিন ভাইয়ের আরো তিন ভাই ছিলেন। নিশাত, মহিউদ্দিন ভাইয়ের বড় পুত্রের নাম। জানিনা প্রিয় মহিউদ্দিন ভাই, ভাবি কেমন আছেন! নিশ্চয় তাঁদের দুই পুত্র এরই মধ্যে বড় হয়ে সংসার পেতেছেন। কতদিন খোঁজ নেওয়া হয়নি, কতদিন আর হয়নি যাওয়া।
গুলিস্থান বা ফুলবাড়িয়ায় বাস থেকে নেমে হট্টন শুরু, পথ বেশি নয়, ইংলিশ রোড মোড় পার হয়ে ডানে ঘুরে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বাম পাশে ছোট পার্ক, জিন্দাবাহার লেনে মেহের আলি ভাইয়ের বাঁধাইখানা। ব্যাপারি পাঞ্জাবী আর পায়জামা পরতেন, গায়ের রং কালোর দিকে, উচ্চতা পাঁচ ফুটের মতো- সঙ্গে মানানসই ভুঁড়ি, মাথায় টাকের পাশে কালো চুল, সর্বক্ষণ পান চিবুতেন। ডাইরি, বই, ক্যালেন্ডার বাঁধাইয়ের জন্য বিখ্যাত। পনের-বিশ জন কারিগরের কর্ম ব্যস্ততায় গমগম করতো তাঁর কর্মশালা। প্রকাশনালয়ে কাজ করার সময় কাজের সূত্রে মাঝে মাঝে আসতাম। এবার নিজের কাজ। বাঁধাইয়ের কাজটা মেহের আলি ভাই করে দিলে খুব ভালো হয়!
এটা বুঝা গেল স্বাভাবিক সাইজের বই বা ডাইরি বাঁধাইয়ের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন কাজ নিয়ে এসেছি। খুঁজে খুঁজে বংশাল থেকে সবচেয়ে ছোট সাইজের কোণা সংগ্রহ করে দেওয়া হলো। মেহেরআলি ভাইয়ের জন্য এই কাজটা অর্থোপার্জনের চেয়ে আয়োজন ও পরিশ্রমই বেশি; যাকে বলে ভালোবাসার অত্যাচার! বিশ টাকা দামের একটা বই বাঁধাইয়ের মজুরি কতইবা হতে পারে! সামান্য মজুরিতে বাঁধাইখানার কর্মীদের পারিশ্রমিকও হবেনা। তাছাড়া এই কাজে বেশ কারুকাজ যোগের বায়নাক্কা আর নানান হাঙ্গামা। নেহাত কাজের মানুষ, কাজ ভালবাসেন বলে মেহের আলি ভাই সেবার কাজটা করে দিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, এর পরে যে কয়টা সংস্করণ বের হয়েছিলো, মেহেরআলি ভাই বাঁধাইয়ের কাজটা করে দিয়েছিলেন আনন্দের সঙ্গেই। তারপর সময় কোথায় যে ভাসিয়ে নিয়ে এলো আজকের এই অজানায়, কতকাল- মেহেরআলি ভাইয়ের আর খোঁজ নেওয়া যায়নি।
অবশেষে কাজটা একদিন শেষ হলো। সামান্য টাকায় কি করে হলো, তা না বলাই ভালো। মিনিয়েচার ডাইরি, টেলিফোন গাইড, নোটবই, না-কি ছোট একটা বই হয়েছিলো তা বলা মুশকিল, তবে চকলেটের মতো লোভনীয় সুন্দর একটা উপহার সামগ্রী হয়তো হয়েছিলো!
ø
ঢাকায় আদি বই ও স্টেশনারি জগৎ নিউ মার্কেটে। নভেলিটি, জিনাত বুক হাউজ, সাদেক বুক ডিপো প্রতিটি দোকানের সামনে বারান্দায় ছোট স্টেশনারির শোকেস স্টল- বিদেশি বিয়ের এবং অকেশনাল নানাবিধ দৃষ্টিনন্দন কার্ড, কলম, পেন্সিল, স্লিপ প্যাড, নোটবই সহ অনেক রকম ফেন্সি জিনিসপত্র পাওয়া যেত। রিয়াজ মামা নামে এক বন্ধু, এরকম সব পণ্য সংগ্রহ করে নিউ মার্কেট সহ ঢাকার বিভিন্ন দোকানে সরবরাহ করতেন। তো রিয়াজ মামা বললেন, ‘আমারে দেন মামা, আমার জিনিসের লগে মার্কেটিং করি, আপনে টাকা পাইলেই তো হলো’। ভালো প্রস্তাব, ছোট একটা আইটেম মার্কেটিং কঠিন, তার আইটেমের সঙ্গে মার্কেটিংটা সহজ হবে। বাংলাবাজারে সারা দেশের পুস্তক ব্যবসায়ীরা আসেন, দেওয়া হলো মোবারক ভাইকেও, তিনি তখন ‘অনন্যা’য় কাজ করতেন। নিজেও দু’চারটা দোকানে ঘুরে ঘুরে দিয়েছি, অভিজ্ঞতা তেমন সুবিধের নয়। আরও তিন-চারটা আইটেম হলে সুবিধা হতো। এঁরা সামান্য আদার ব্যাপারীকে সাধারণত গুরুত্ব দেন না, তারা জাহাজের খোঁজ রাখেন। ভাবখানা এমন, দোকানে রাখতে পারি, দিয়ে যাও- বিক্রি হলে টাকা পাবে!
হোক যতই সামান্য! এবার বন্ধু কবি আসাদুজ্জামান শেখরকে সঙ্গী করে বাণিজ্যে যাত্রা, ‘মনে করো তাম্রলিপ্তি থেকে নৌ-বহর ছাড়ছে তোমার’, না কোনো নৌ-বহর নয়, ট্রেনেই যাত্রা করলাম শ্রীহট্টের উদ্দেশ্যে, সাথে ছোট ব্যাগ। সিলেটের রবীন্দ্রনাথ, গণমানুষের কবি দিলওয়ার তনয় কবি কিশোয়ার ইবনে দিলওয়ার বন্ধুজন। বেশ ক’বছর ঢাকায় তাঁর সঙ্গে চমৎকার সময় কেটেছে- যাক, এবার দুজনের সঙ্গেই দেখা হবে। দর্গা গেটের লাগোয়া একটা ছোট হোটেলে উঠা গেল। পরদিন কাক ভোরে বের হলাম শেখর আর আমি। কবি দিলওয়ারের ‘কীনব্রীজে সূর্যোদয়’ কবিতাটা পড়ে কেমন একটা আবেশ জেগেছিলো একসময়, সেই আবেশের রোমাঞ্চ নিয়ে ওই ভোরে কীন সাহেবের ব্রিজের মাঝে এসে দাঁড়ালাম, ভোরের স্নিগ্ধ বাতাস, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ হয়ে এলো-
‘নীচে জল কলকল বেগবতী নদী সুরমার,
কান পেতে শুনি সেই অপরূপ তটিনীর ভাষা;
…..
সহসা ফিরিয়ে নিয়ে চোখ দেখি দূর পূবাকাশে
তরুণ রক্তের মতো জাগে লাল সাহসী অরুণ
পাখীর কাকলি জাগে। ঝিরঝিরে শীতল বাতাসে
দিনের যাত্রার শুরু। অন্তরালে রজনী করুণ!
ধারালো বর্শার মতো স্বর্ণময় সূর্যরশ্মি ফলা
কীন ব্রীজে আঘাত হানে। শুরু হয় জনতার চলা।’
ব্রিজটা পার হয়ে অল্প কিছু দূরে হেঁটে গেলেই ভার্থখোলা, সেই ভোরে পথ চলতি মানুষের কাছে দিক জেনে নিয়ে কবি দিলওয়ারের বাড়ি গেলাম।
‘পদ্মা তোমার যৌবন চাই
যমুনা তোমার প্রেম
সুরমা তোমার কাজল বুকের
পলিতে গলিত হেম।’
তাঁকে তিনটে লেখক কপি দিতে হবে, তাঁরও কবিতা আছে যে এই ছোট বইয়ের কবিতাংশে। সিলেট তখন শান্ত নিরিবিলি একটা শহর, শুধু জিন্দাবাজারই ব্যস্ততম এলাকা, ওখানেই একটা দোতলা মার্কেটে বেশ কিছু বইয়ের দোকান, এদিক-সেদিক আরো কিছু দোকানে ঘুরলাম। শামীম শাহান, আহমদ মিনহাজ, মোকাদ্দেস বাবুল সহ স্থানীয় তরুণ কবি-লেখক, লিটলম্যাগ ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের সঙ্গে আড্ডায় কিছু আনন্দময় সময় কাটিয়ে, কাছাকাছি দু’একটা ছোট-খাট পাহাড় বেড়িয়ে তিন-চার দিন, হোটেলে থাকা ও খাওয়া-দাওয়া খরচ বাদ দিয়ে হাজার দুয়েক টাকা পকেটে নিয়ে প্রথম বাণিজ্য যাত্রার সমাপ্তি হলো।
ø
এরপর কিছু দিন কেটে গেল। ফেনিয়ে এত যে গল্প হলো- তারপর কি হয়েছিলো! রিয়াজ মামা আর মোবারক ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা পেয়েছিলাম ঠিকঠাক, সিলেটেও নগদ বিক্রি, কিন্তু আমি নিজে যেসব দোকানে দিয়েছিলাম তার অনেকটাই অনাদায়ী রয়ে গেল। বিক্রেতার পঁয়ত্রিশ পার্সেন্ট কমিশন বাদ দিয়ে একশ তিরিশ বা দু’শ ষাট টাকা মাত্র। একেবারে খালি পকেট, হয়ত মাসখানেক পর টাকা ক’টার আশায় গেলাম, অনেকটা মাছি তাড়াবার মতো উত্তর- ‘বিক্রি নাই, কয়েকদিন পরে আসেন’। ক’বার আর যাওয়া যায়! আবার যদি ফিরিয়ে দেন, এই ভয়ে আর যাওয়াই হতো না।
তবে একটা সুবিধে হলো এই যে, বইগুলো কিছু মানুষের কাছে ছড়িয়েছে! যাঁরা নিয়েছেন বা পেয়েছেন তাঁদের কেউ কেউ সরাসরি খোঁজ করতে শুরু করলেন। পুরনো ঢাকার এক তরুণ খুঁজে খুঁজে একদিন বাসায় এলেন, বড় বোনের গায়েহলুদে অতিথিদের উপহার দেবেন, এক’শ পিস চাই। কি করা! স্টক শেষ, টুকটাক সংশোধন ও বইয়ের নাম বদল করে রিপ্রিন্ট করে দেওয়া হলো। এভাবে চারটি সংস্করণ রেকসিন দিয়ে ডাইরির জেল বাইন্ডিংয়ে প্রকাশের পর পঞ্চম সংস্করণে কভার আর্ট কার্ডে ছেপে পেপারব্যাক বাধাঁইয়ে প্রকাশ করা হয়েছিলো। এই পঞ্চম ও শেষ সংস্করণে শিল্পী নাজিব তারেক কভার ডিজাইন করেছিলেন।
একটা সময় হঠাৎ কি যেন হয়ে গেল, পশ্চিমে সূর্য উঠতে শুরু করলো আর কী! ঐ যে আগে দর্শনধারী- দেখতে বোধ হয় ভালোই হয়েছিলো, ফলে হয়তো কোথাও ভুল বার্তাও গিয়েছিলো।
একদিন একটা সুন্দর খাম এলো ডাকে, অবাক হওয়ার মতোই ব্যাপার। এমন হওয়ার কোনো কারণ দেখিনা! মৌখিকভাবে দেখা হলে কালেভদ্রে দাওয়াত পাই কবিতা পাঠ, সাহিত্য আসর বা সাধারণ কোনো সভার; কিন্তু ‘লৌকিকতার শৌখিনতার’ আনুষ্ঠানিকতায় এটাই প্রথম আমন্ত্রণ! লালের প্রাধান্যে সুন্দর একটা কার্ড, তাও আবার রূপকথার জগতের শাবানা আজমি আর ফারুখ শেখের দ্বৈত অভিনীত একটা মঞ্চ নাটক দেখার আমন্ত্রণ, নাটকের নামটা আর মনে নেই, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে। ডাকে পাঠানো হলো আমারই ঠিকানায়, অবাক কাণ্ড! ঠিকানা পেল কোথায়! তেমন গণ্য-মান্য কেউতো নই! কার্ডে ইংরেজি বয়ানটায় পরিষ্কার হলোনা এটা আমন্ত্রণপত্র না টিকেট কেটে দেখার আমন্ত্রণ। সর্বনিন্ম পাঁচ’শ টাকার টিকেট এমনও এক জায়গায় লেখা ছিলো। দু’চার দিন একটু বেশ রোমাঞ্চকর ও দ্বিধার মধ্যে কাটলো। শেষ-মেষ এরকম দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আর দেখতে যাওয়া হলো না।
একটা পোস্ট কার্ড এলো একদিন ড. কুদরাত-ই-খুদা সড়ক থেকে, লিখেছেন মো. রফিকুল ইসলাম। যাহ্ বাবা, এটা আবার কোন সড়ক! এলিফ্যান্ট রোডই যে কুদরাত-ই-খুদা সড়ক, যাক জানা গেল। তিনি লিখেছেন, “শ্রদ্ধাভাজনেষু বাহার রহমান, নববর্ষের শুভেচ্ছা। নিত্য উপহারের ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’- টেলিফোন গাইডের অপেক্ষায় ছিলাম এ বছর। এখনো পাইনি দুর্ভাগ্য আমার। এত চমৎকার উপহার এ দেশে আমি কম দেখেছি- বাড়াবাড়ি করে বলছি না- সত্য। এ জন্য ধন্যবাদ আপনাকে- আপনাদের শৈল্পিক মূল্যবোধের। এটা কোথায় পাওয়া যাবে? অথবা আপনি দয়া করে পাঠালে বাধিত থাকব। বিনিময় মূল্য চাইলে তাও আমি পাঠাব।”
তাজ্জব ব্যাপার! চিঠি এলো হংকং থেকে! তাঁদের সবিনয় বক্তব্য এই যে, ‘বেসিকলি উই আর স্পেশালাইজড অন সিগারেট পেপার, বাট প্লিজ ডোন্ট হেজিটেড টু রাইট মি, ইফ ইউ নিড এনি টাইপ অফ চাইনিজ পেপার।’ চিঠির সঙ্গে কয়েক তা সিগারেট পেপারের নমুনাও পেলাম। ঠিকানা পেল কি করে! নিত্য উপহারকে এত বড় ভাবার কারণ কী! কাগজ আমদানি করতে যাবই বা কোন দুঃখে! ঘর থেকে বের হওয়ার যোগাড় থাকেনা যার, উনি আসছেন তার কাছে টন টন কাগজ গছাতে! রেজলার বদলে ওই কাগজে বিড়ি বানিয়ে ধূমপান করা গেলো ক’দিন। এর মধ্যেও একটা উজ্জীবিত হওয়ার মতো ব্যাপার ছিলো- একটা মিষ্টি ঘোরে বেশ ক’দিন কেটে গেল।
দিল্লি থেকেও একই ধরনের কথাবার্তা লেখা আরেকটা চিঠি এলো। অদ্ভুত ব্যাপার! শিভা পেপার মিল থেকে ডি কুমার লিখেছেন, ‘উই আন্ডাস্টেন্ড ইউ আর ইমপোর্টিং ভ্যারিয়াস টাইপস অফ পেপার ফর ইউর ওউন রিকোয়াইরমেন্ট এজ ওয়েল এজ ফর ট্রেডিং ইন ইউর কান্ট্রি।’ এঁরাও দেখছি নিত্য উপহারকে কোনো বড় প্রতিষ্ঠান ঠাঁউরেছেন!
ø
না, এতকাল পরে আমার কালো বাক্সে নেই, নেই ঘরের বস্তুপুঞ্জের মধ্যেও। নেই ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ এর কোনো কপি। আর ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’ -এর যে কয়টা সংস্করণ হয়েছিলো, নেই তারও কোনো কপি আজ। তবু নির্জন ঘরে এই বস্তুগুলোর সামনে বসে প্রায় ভুলে যাওয়া সেই দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে বেড়াতে লাগলো। খড়কুটোর মতো সামান্যকে আঁকড়ে ধরে কত যে স্বপ্ন দেখেছিলাম! কত অচেনা-অজানার সঙ্গে হয়েছে চেনা-জানা, কত দূরের মানুষ এসেছেন কাছে, অতিমারিকালের অলস মন্থর দুপুর-বিকেলে সেসব স্মৃতিরা স্বপ্নের মতো এসে একে একে ভিড় করতে লাগলো।
বছর পাঁচেক আগে একটা জরুরি কাজে শিল্পী খাজা জিয়ার অফিসে গিয়েছি। কথাবার্তা শুরুর আগে একটা শোকেস ইশারায় দেখিয়ে বললেন, ‘দেখেন।’ কাছে গিয়ে তাকিয়ে দেখি, বিভিন্ন মডেলের পুরনো সব ক্যামেরার সংগ্রহ, আছে বইপত্রসহ আরো নানান দ্রষ্টব্য সাজানো, অবাক কাণ্ড, এসবের সামনেই যত্ন করে রাখা আছে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’ ছোট বইটার তিনটে সংস্করণ। বললেন, ‘দেখছেন, কেমন যত্ন করে রেখেছি!’
জ্যাক মা সাহেব, আজকের দুনিয়ায় সাড়া জাগানো ব্যবসায়ী একটা কথা প্রায়ই বলে থাকেন, ‘স্মল ইজ বিউটিফুল।’ জিয়া ভাইয়ের শোকেসটা যেন তারা ভরা এক আকাশ, আর সেই আকাশে তারার মতো ছোট সেই বইটা মিটি মিটি আলো ছড়াচ্ছে। সত্যি, হোকনা যতই ক্ষুদ্র, তবু সুন্দর- খুবই সুন্দর লাগছিলো দৃশ্যটা। (চলবে…)
বাহার রহমান
১৫ জুলাই, ২০২০