একটি পোশাকের ডিজাইনের শুরু কোথা থেকে! কী করে একটু একটু করে কল্পনায় মূর্ত হতে হতে তা বাস্তব হয়ে যায়। লিখিত হওয়ার আগেই কবির মস্তিষ্কে কখন, কীভাবে কবিতার পঙ্ক্তিগুলো নেচে ওঠে, মূর্ত হয়, কে জানে!
যে কাজটা আমরা বাস্তবে আজ করছি বা করেছি, তা আসলে অতীতে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা বা কাজের প্রতিক্রিয়ার ফলাফল। বলা যেতে পারে, এটা অনেকটা ‘বাটারফ্লাই ইফেক্ট’–এর নিয়মেই বাঁধা। ‘পতাকা’ টি-শার্টও তেমনি অতীতে ঘটে চলা কিছু ঘটনার প্রতিক্রিয়া, কোনো ঘটনার সংবেদনশীলতার প্রতিফল, দেশীয় ঘরানার স্মারক তৈরির এক চেষ্টা।
এটা ঠিক, নানা দেশের পতাকার প্রতিরূপ, পরিচায়ক অন্যান্য মোটিফে অলংকৃত অনেক টি-শার্ট আমাদের চারপাশের মানুষের গায়ে প্রতিনিয়ত শোভা পাচ্ছে। সেকেন্ডহ্যান্ড বাজারের পোশাকই একসময় সহায়ক ছিল, আজ পোশাক রপ্তানিশিল্পের সার্বিক সাফল্যে এটা সহজতর হয়েছে। এটাও ঠিক, পোশাক আমদানিও আমাদের দেশে সব সময় হয়েছে। কাছের মানুষদেরই বলতে শোনা যায়, ‘এই টি-শার্ট আমার খালা বা বন্ধু আমার জন্য বিদেশ থেকে এনেছেন।’ এ রকম ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে, এসব দৃশ্যে কিছুটা অনুভূতিশীল না হওয়াটাই তো অস্বাভাবিক।
এপ্রিল, ২০০৪। স্লোভাকিয়া থেকে বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছেন তরুণ পরিব্রাজক টম বরিস। ঢাকার পথঘাট, মানুষজন, বাড়িঘর দেখছিলেন ঘুরে। নীলক্ষেতে পুরোনো বইয়ের দোকানে এক তরুণের প্রতি তাঁর দৃষ্টি আটকাল। তাঁর গায়ের টি-শার্টটাই তাঁকে আলাদা করে তুলেছিল। ‘এ রকম টি-শার্ট কোথায় পাব?’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সেই তরুণ শরিফ উত্তরে বললেন, ‘আমি ওদিকেই যাব—চাইলে আমার সাথে তুমিও আসতে পারো।’
হাতে ভ্রমণসহায়ক নির্দেশিকা, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে এলেন তিনি, কিছুটা গল্পও হলো। ‘আচ্ছা, তোমাদের পতাকার প্রতিফলন আছে, এমন টি-শার্ট নেই?’ বললাম, ‘তুমি কদিন আছ? চেষ্টা করব।’ বললেন, রাজশাহীতে আম খাবেন, ফিরবেন ৭ দিন পর, যাওয়ার সময় টি-শার্টও নিয়ে যাবেন—কিন্তু এলেন প্রায় ১৫ দিন পর। রাজশাহী থেকে বরিশাল, তারপর গিয়েছিলেন চট্টগ্রাম। বিপত্তি ঘটল বন্দরনগরীতেই, ফুটপাত ধরে হাঁটছিলেন—হঠাৎ পেছন থেকে স্কুটারে এসে ছোঁ মেরে কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে হাওয়া। দরকারি কাপড়, নোটবুক আর গ্র্যাজুয়েশন শেষে বিদেশ ভ্রমণের আগে পিতার দেওয়া উপহার ক্যামেরাটাও গেল।
শেষ পর্যন্ত টমকে স্মারক টি-শার্ট দেওয়া সম্ভব হয়নি তাঁর যাওয়ার আগে। এর মধ্যে টমের কাঁধব্যাগ ছিনতাই! বেশ লজ্জার ব্যাপার! ১০ টাকা, ৫০ টাকার নোট কুড়িয়ে সাড়ে ৪০০ টাকা দিলেন। দুটি টি-শার্ট নিয়ে যাবেন আর একটার দাম অগ্রিম—ওই স্বপ্নের স্মারক টি-শার্টটা যেন ডাকে পাঠিয়ে দিই। হাতে সময় কম, পরদিনই কলকাতার পথ। জাদুর শহর ঢাকায় আরও কিছু কাজ বাকি তখনো টমের, তাই টম ও শরিফ দুজনই বেরিয়ে গেলেন।
জুন কি জুলাইয়ে টমের মেইল পেলাম, ‘টেলিভিশনে দেখছি, তোমার দেশে বন্যা হয়েছে, তুমি ঠিক আছ তো? টি–শার্ট পেয়েছি। খুবই ভালো হয়েছে। একদিন দেখবে, তোমার এই টি-শার্ট অনেক জনপ্রিয় হবে। এবার বেশি টি-শার্ট নিতে পারিনি, আবার বাংলাদেশে আসব, তোমার অনেক টি-শার্ট নেব। স্থানীয় পত্রিকায় আমার ভ্রমণবৃত্তান্ত নিয়ে একটা লেখা লিখছি। বছর শেষে ইংল্যান্ডে পড়াশোনার জন্য যাব ভাবছি। শুভকামনা।’
সে বছরের শেষে প্রথম আলোর ‘নকশা’র বিজয় দিবস সংখ্যার শেষ পাতায় একটি লেখা ও ছবি ছাপা হয়েছিল। লাল–সবুজ টি-শার্ট পরে মডেল কান্তা, নিশো আর ধীয়ান গিরির গায়ে একটা বড়দের টি-শার্ট, হাতে একটা ক্রিকেট ব্যাট। নকশার ওই সংখ্যায় লাল–সবুজ পোশাকে সেই একটাই ছবি ছিল যত দূর মনে পড়ে। সে বছর অন্যান্য জাতীয় দৈনিকের ফিচার পাতাগুলোয় এ নিয়ে বেশ ছবি ও লেখা ছাপা হয়েছিল।
সময়ের বিবর্তনে স্মারকের ধারণাও বদলেছে। পরিব্রাজক ইবনে বতুতা হয়তো স্মারক হিসেবে মসলিনই নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রিয় টম, আপনাকে একটা টি-শার্টই দেওয়া গেল। আপনার কথাই সত্যি হয়েছে, এই টি-শার্ট শুধু জনপ্রিয়ই হয়নি, আমাদেরও নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে।
বাহার রহমান
ফ্যাশন হাউস নিত্য উপহারের স্বত্বাধিকারী
[ লাল-সবুজের স্মারক চর্চা লেখাটি দৈনিক প্রথম আলোর পত্রিকার নকশায় ২৬ মার্চ ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত হয়েছিলো। মূল পত্রিকায় এই লিংক থেকে পড়া যাবে।]